এটা একটা CGPA এর গল্প।
ইউনিভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টারে আমি ৩.৮৯ পাই। আশা ছিল ৪.০০ পাবো। কিসের কি, এটা তুলতেই ঘাম ছুটে গেল। তখনও আমি প্রোগ্রামিং শিখিনি। অন্য বন্ধুরা ৩.৯০+ পেল। কয়েকজন তো ৪.০০ ও পেল। আমি খুব হতাশ হলাম। কি আর করা। বুঝলাম আমি ভালো স্টুডেন্ট না। আমার থেকেও বড় বাঘ আছে।
২য় সেমিস্টারে প্রোগ্রামিং শিখার পর আর ৩য় সেমিস্টারে কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং শুরু করার পর অন্যদের মত আমারও মাথা বিগড়ে গেল। কোর্স নিয়ে হেলাফেলা শুরু করে দিলাম। খালি প্রবলেম সল্ভ করতে লাগলাম।
২য় বর্ষে আমার CGPA হোল ৩.৪৮। আমি বিকারহীন। একদিন লাইব্রেরীতে আমার এক ক্লাসমেটের সাথে লেখাপড়া করছি। সে আমার তেমন ভালো বন্ধু ছিল না। একটু পাগলা কিসিমের। ঐ সেমিস্টারেই পরিচয় আর দলে ঢুকে গেল। বেশ মিশুক ছিল তাই মেশা হত।
সেই দিন কথায় কথায় সে আমার CGPA জিজ্ঞাসা করল। আমার CGPA শুনে সে মন্তব্য করলো যে আমার জন্য CGPA টা কম, আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। তার CGPA তখন ৩.৮২ এমন কিছু। আর সে তেমন ভালো না, ফাকিবাজ। আমি বললাম, ব্যাপার না, সামনে CGPA তুলে ফেলবো। সে বলল, এটা সম্ভব না, CGPA সামনে আরও কমবে। CGPA কখনো বাড়ে না।
আমি চ্যালেঞ্জ করে বললাম অবশ্যই বাড়ানো সম্ভব। সেও চ্যালেঞ্জ ছুরে দিল যে যদি আমি করে দেখাতে পারি যে আগামী সেমিস্টারে আমার CGPA বেড়েছে তাহলে সে আমাকে বার্গার খাওয়াবে। আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিলাম। সেমিস্টার শেষের আগেই সে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে বিদেশে চলে যায়।
চ্যালেঞ্জটা এখানেই থেমে যেতে পারতো। যেভাবে আমরা অনেকেই আড্ডায় গল্প করি, তারপর ভুলে যাই। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্ আমার ফোকাস ভালো। আমি কথা বলার জন্য বলি না। আমি স্বভাবতই বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম।
আমি দেখলাম যে আমি গাফিলতি করে CGPA নষ্ট করছি। আমি বেকে বসলাম। আরও জোরেসোরে কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং শুরু করলাম কিন্তু পরীক্ষার পড়া ঠিকমত পড়তে লাগলাম। পথ বের করতে লাগলাম যে কিভাবে কম সময় আমি রিভিশন দিতে পারি, কিভাবে একবার পড়ে মনে রাখতে পারি। এমন হয়েছে, আমি অনেক কোর্সে কেবল পরীক্ষার আগের রাতে পড়েছি। অনেক সময় কেবল বাসের মধ্যে পড়েছি। পরীক্ষার হলে ঢুকার আগে সিঁড়িতে পড়েছি। ঐ সময়গুলোই আমার পড়ার মূল সময় ছিল।
কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং আর এভাবে বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে আমি এক অভিনব কাজ করতে থাকলাম। আর তা হোল কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং আমার বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি বাড়াতে থাকল। আর সেটা ব্যাবহার করে আমি বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম যে স্যার পরীক্ষায় কি প্রশ্ন করতে পারে। যেটা জানি না সেটাও বানিয়ে কিভাবে লিখে মার্ক পাওয়া যেতে পারে। সোজা কথায় পরীক্ষা বিষয়টা আমি হ্যাক করে ফেললাম। তবে এর মানে এই নয় যে আমি কোর্সগুলো থেকে কিছু শিখিনি। আমার সৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি, কম সময় কিভাবে পড়া যায়, এই সব অ্যাপ্লাই করে আমি খুব সহজে পরীক্ষায় ভালো করতে থাকলাম, কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং এ সময় না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে। আর সাথে সাথে আমি অনন্য সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট নিয়েও কাজ করতে থাকলাম। এভাবে যত আমি দক্ষ হতে থাকলাম, আরও জানতে থাকলাম, ইউনিভার্সিটির লেখাপড়া আমার কাছে দুধভাত হয়ে যেতে থাকল।
তবে বিষয়টা এমন না যে আমি জিনিয়াস ছিলাম। অনেক প্রেসার নিয়ে আমাকে কাজটা করতে হয়েছে। প্রতি পরীক্ষার আগে আমার মনে হত এইবার ফেল করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, কারণ কিছুই তো পড়া হোল না। তাও কিভাবে যে পার পেয়ে জেতাম আল্লাহ্ জানে। আমার মনে হয় আমার বাকি বন্ধু আর সিনিয়ররা আমার থেকে অনেক অনেক ভালো ছিল। আর তারাও ভালো রেজাল্ট করেছে আর কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং এও আরও অনেক ভালো ছিল। কাজেই বিষয়টা আসলে আমার জন্য নতুন কিছু ছিল না। আমাদের মধ্যে আমিই মনে হয় সবার থেকে কম CGPA নিয়ে বের হয়েছি।
এভাবে প্রায় পরবর্তী প্রতি সেমিস্টারে আমি ৪.০০ বা তার কাছাকাছি পেতে লাগলাম। কিন্তু CGPA তো আর বাড়ে না। প্রথম ৪.০০ পাওয়ার পর ভেবেছলাম একলাফে হয়ত ৩.৪৮ থেকে ৩.৫৫ হয়ে যাবে। কিসের কি হোল ৩.৪৯। এভাবে ২ বছর এত ভালো করার পরও আমার CGPA আমার প্রাথমিক লক্ষ্য ৩.৭৫ এর কাছে নিয়ে যেতে আমার এমন ঘাম ঝরছিল যে আমি হালই ছেড়ে দিয়েছিলাম যে আমি ৩.৭৫ পাবো। তবে আমি বাজি জিতেছি। আমি ঐ দিন থেকে কখনো আর CGPA কম পাইনি। সব সময় বেড়েছে।
একদম শেষ পর্যন্ত আমার CGPA ৩.৭৪ এ এসে শেষ হোল। মাত্র ০.০১ এর জন্য আমার লক্ষ্য পূরণ হোল না। এই দুঃখ মাথা পেতে নিলাম এই মনে করে যে, যাক একদম কাছে আসতে তো পেরেছি। মজার বিষয় আমার একটা কোর্স এর ক্রেডিট পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল। ইউনিভার্সিটির কারিকুলামে পরিবর্তনের কারণে। আমি অ্যাডমিন রুমে গেলাম, পরিবর্তন করে আমাকে নতুন ট্রান্সক্রিপ্ট ধরিয়ে দেয়া হোল, সেখানে লেখা ৩.৭৫। কাগজটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, তারপর হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম দুনিয়া কত আজব।
শেষ পর্যন্ত আমি ৩.৭৫ পেলাম যেটা আমার প্রথম সেমিস্টার থেকে লক্ষ্য ছিল যে এটা নিয়ে বের হতে হবে। এখনো বিষয়টা মনে পরলে মনে হয় যে মানুষ যখন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে চেষ্টা করে তখন এভাবেই অভিনব ঘটনার মাধ্যমে সে সেখানে পৌঁছে যায়। আল্লাহ্ই ব্যবস্থা করে দেন।
এটা তাই আমার জীবনের অনেকগুলো অভিনব ঘটনার মধ্যে একটা হয়ে থাকল। সেদিন যদি আমার ঐ সাময়িক বন্ধু আমাকে চ্যালেঞ্জ না করত তাহলে হয়ত আমার জীবনের মোড় এভাবে ঘুরত না। CGPA আমার জীবনে কোন কাজে লাগেনি এখনো, তবে যেটা লক্ষ্য ছিল সেটা পূর্ণ হওয়া অবশ্যই তৃপ্তিদায়ক।